দেশে পঙ্গুত্বের কারণ হিসেবে প্রথম এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্ট্রোক। অথচ রোগটি নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব যেমন রয়েছে তেমনি চাহিদার তুলনায় এগোয়নি চিকিৎসার সুবিধা। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেই কোনো স্ট্রোক ইউনিট। এতে রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

মানুষের মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে অথবা ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়াই হলো স্ট্রোক। দেশে পঙ্গুত্বের কারণ হিসেবে প্রথম এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এ রোগটি।
৫২ বছর বয়সী ময়মনসিংহের ফুলপুরের বাসিন্দা বাবুল হোসেন। প্রায় এক মাস আগে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষটি কথা বলতে বলতে হয়ে পড়েন অসুস্থ। পরিবারের সদস্যরা প্রথমে বুঝতেই পারেননি বাবুল স্ট্রোক করেছেন।
গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন ৭০ বছর বয়স্ক শুকুর আলী। প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকদের পরামর্শে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষায় ধরা পড়ে স্ট্রোক। তবে রোগ নির্ণয় আর চিকিৎসকের সেবা পেতেই কেটে যায় মহামূল্যবান সময়।
রোগীর স্বজনেরা জানান, প্রাথমিক চিকিৎসা নিতেই ৮ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। সময় মতো চিকিৎসা করাতে পারলে রোগী সুস্থ হয়ে যেতেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোকের চিকিৎসায় প্রথম চার ঘণ্টা সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেকেই জানেন না বিষয়টি। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানুষের ভ্রান্ত কিছু ধারণাও বিপত্তি ঘটায় স্ট্রোক চিকিৎসায়।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (নিউরোসার্জারি) ডা. মো. সুমন রানা বলেন, স্ট্রোক আসলে ব্রেইনের রোগ, এটা হার্টের রোগ নয়। অনেকেই আছে স্ট্রোককে হার্টের রোগ মনে করে, হার্টের হাসপাতালে চলে যান। অনেক সময় চিকিৎসকরাও রেফার করে থাকেন। আর এসব কারণে চিকিৎসা পেতে কালক্ষেপণ হয়, তখন রোগীকে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ থাকে না।
তিনি বলেন, স্ট্রোকের সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে নিয়ে আসলে শিরা পথে একটা ইনজেকশন দিয়ে, ব্রেইনের স্ট্রোকে যে রক্ত নালী ব্লক হয়ে গেছে সেটাকে আমরা ডিসল্যুশন করতে পারি। ৮ ঘণ্টার মধ্যে আসলে একটা জালিকার মাধ্যমে রক্তনালীর স্লটটাকে বের করে আনতে পারি এবং ব্রেইনের স্বাভাবিক রক্ত চলাচল প্রতিস্থাপন করতে পারি। এক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, অনেক সময় প্যারালাইজড রোগী হেঁটে বাসায় চলে গেছেন।
কারও যদি মুখ বেকে যায়, কার হাত অথবা পা যদি একদিকে অবশ হয়ে যায়, অথবা তার কোনো একটি চোখে সাময়িক দৃষ্টিশক্তি বা স্থায়ী ড্যামেজ হয়ে যায়, কথা বলতে যদি অস্পষ্টতা হয়। এ উপসর্গগুলো অবশ্যই স্ট্রোকের। এ উপসর্গগুলো বুঝে স্বজনদের তৎক্ষণাত রোগীর সঠিক চিকিৎসার নেওয়ার বিষয়েও পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে স্ট্রোক চিকিৎসায় বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (নিউরোসার্জারি) ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে পঙ্গুত্বের কারণ হিসেবে প্রথম এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্ট্রোক। আমরা ক্যান্সার নিয়ে চিন্তা করি, ক্যান্সার এতো বড় একটা রোগ। কিন্তু এটা কম ভয়াবহ না। এটাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের এক হয়ে এটার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা উচিত।
তিনি বলেন, আমাদের দেশেই বিশ্বপ্রযুক্তিতে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। অনেক রোগী বিদেশ থেকে ঘুরে এসেছে সেটা কিন্তু আমরা এখানেই চিকিৎসা করেছি। আমরা যদি এ ধারাটা অব্যাহত রাখতে পারি, তাহলে বিদেশে যাওয়ার যে প্রবণতা সেটা কমানো সম্ভব।
তবে স্ট্রোকের চিকিৎসায় বড় অন্তরায় চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। চিকিৎসা সেবায় দেশের মানুষের প্রধান এ আশ্রয়স্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো স্ট্রোক ইউনিট না থাকায় কাঙ্ক্ষিত সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, এর জন্য নিজস্ব কোনো স্পেস নাই। আমরা আপাতত দুই ভাগে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। এটা হচ্ছে সার্জারি, অপরটা হচ্ছে মেডিসিনে। আমরা চিন্তা করছি কীভাবে নিউরো মেডিসিনে কিছু রোগী স্থানান্তর করা যায়। আমরা যদি তিন-চারটা জায়গায় স্থানান্তর করতে পারি, তাহলে মোটামুটি চিকিৎসা দিতে পারব।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ধূমপানসহ কিছু বদ অভ্যাস এড়িয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব স্ট্রোক।
বিশ্ব স্ট্রোক দিবস ২৯ অক্টোবর। ‘না করলে সময়ক্ষেপণ, স্ট্রোক হলেও বাঁচবে জীবন’- এ স্লোগানকে সামনে রেখে নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএসও) এ দিবসটি পালন শুরু করে।
Post a Comment